গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ (প্রতিষ্ঠাতা- আওলাদে রাসূল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.)

গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ একটি সমাজ সংস্কার মূলক অরাজনৈতিক আন্দোলন। সমাজ সংস্কারের পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ; অর্থাৎ যারা এই সমাজ সংস্কারে নেতৃত্ব দেবে প্রথমে তাদের আত্মশুদ্ধি নিশ্চিতকরণ। এজন্যে গাউসিয়া কমিটির পরিকল্পনা হলো- ১. গাউসুল আ’যম জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র সিল্‌সিলাহর কামিল প্রতিনিধির হাতে বায়’আত ও সবক গ্রহণের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির এ পাঠশালায় অন্তর্ভুক্তকরণ। ২. গাউসিয়া কমিটির সদস্য বানিয়ে তাদেরকে এমন প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা ধীরে ধীরে আমিত্ব, হিংসা বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ও অহঙ্কারমুক্ত পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে পরিণত হয়। ৩. সুন্নীয়তের আক্বীদা এবং ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির সাথে সাথে উভয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় মৌলিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নেতৃত্বের উপযোগী কর্মি হিসেবে গড়ে তোলা। ৪. সুন্নীয়ত ও ত্বরীকতের দায়িত্ব পালনে, বিশেষতঃ মাদরাসা, আনজুমান এবং মুর্শিদে বরহক্বের নির্দেশের প্রতি আস্থাশীল এবং মুর্শিদের বাতলানো পথে নিবেদিত হয়ে নবী প্রেমিক এবং খোদাপ্রাপ্তির পথ সুগম করার অনুশীলনে নিরলসভাবে এগিয়ে চলার শপথ গ্রহণ করা।

গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো সিলসিলার দাওরা বিশেষত ত্বরিকতের নতুন ভাই বোনদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও নসীহতের ব্যবস্থা করা। এ ধরনের অনুষ্ঠান কোন অঞ্চলে হুজুর কেবলা’র মাহফিল এবং বায়াতী কার্যক্রম সম্পন্ন হবার অব্যবহিত পরেই করতে হয় যাতে নবাগত পীর ভাই-বোনরা তাদের জীবনের এ নতুন আধ্যাত্মিক অধ্যায় সুন্দর ও সহজভাবে গ্রহণ করে অগ্রসর হতে পারে। এ মাহফিল সিলসিলাহ’র সবক নসীহত, দ্বীনি খিদমত, আনজুমানের আনুগত্য করা এবং খতমে গাউসিয়া,গেয়ারভী শরীফ, মাদরাসা-খানকা পরিচিতি সহ প্রয়োজনীয় করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ে শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা মাহফিলটি একই সাথে নুতন-পুরাতনদের পরিচিতি ও মিলন মেলা হিসেবে পরিণত করা।  একে আমরা পীর ভাই-বোনদের সম্মেলন নাম দিয়ে প্রতি বছর প্রতিটি কমিটির আওতায় অন্তত একবার আয়োজন করা উচিত  বলে মনে করি।

১৯৭৫ সন থেকে তাঁরই নির্দেশে শুরু হয়েছে চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে ‘জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মতো একটি শরীয়ত সম্মত বর্ণাঢ্য মিছিলের কর্মসূচী; যাতে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ শামিল হয়ে এ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ সংস্কারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বিশেষ করে গাউসে পাক’র স্মরণে প্রতি মাসের গেয়ারভী শরীফ এবং খতমে গাউসিয়া শরীফসহ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি’র যুগান্তকারী মসলকে আ’লা হযরত প্রচার-প্রসারের যে যাত্রা হযরত সিরিকোটী হুযূরের হাতে শুরু হয় তা তাঁর হাতে লাভ করে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। মোট কথা ১৯৮৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই গাউসে পাকের এই কাফেলায় শামিল হয় দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেশের আনাচে কানাচে চলতে থাকে এ মিশনের কার্যক্রম। এ বিশাল কর্মী বাহিনীকে একটি সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে, দ্বীনের সাহায্যের কাজে নিয়োজিত করে তাদের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য গাউসে যামান তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি ১৯৮৬ সনে নির্দেশ দিলেন ‘গাউসিয়া কমিটি’ প্রতিষ্ঠা করতে।

আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট

আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে ইসলামের প্রচার-প্রসারকালে ১৯২৫ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন আনজুমান-এ শুরা-এ রহমানিয়া’। এরপর তিনি ১৯৩৫ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সফর করেন। দু’বছর পর ২৯ আগস্ট ১৯৩৭ সালে ইয়াঙ্গুন থেকে আসা বাঙালি পীর ভাইদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে সংস্থাটির গোড়াপত্তন হয়। ১৯৪১ সালে হুজুর কেবলা সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি ইয়াঙ্গুন থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রামে তশরীফ আনেন। ২২ জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে এ সংস্থাটি পুনঃগঠন করা হয়। চট্টগ্রাম এবং দেশের অন্যান্য স্থানে নতুন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসা, খানকাহ্ প্রতিষ্ঠার জন্য আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামকরণ করা হয়। এর কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ৩৯ আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রামে। পরবর্তী ১৮ মার্চ ১৯৫৬ সালে আনজুমানকে অরাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জনহিতকর সংগঠন হিসেবে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’ নামে পুনঃগঠন করা হয়। যা দেশের সুন্নী মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ধর্মীয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে।
আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ১৮৬০ সালের রেজিস্ট্রেশন অফ সোসাইটিজ অ্যাক্ট XXI এর অধীনে যথাযথভাবে নিবন্ধিত হয়। এর Registration No. 1237 E.P. /82 of 1958-59. (CHS- 1237)। আনজুমান মানে সংস্থা/সংগঠন, রহমানিয়া নেওয়া হয়েছে হজরত আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি-এর নাম থেকে, আহমদিয়া নেওয়া হয়েছে হজরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি-এর নাম থেকে, সুন্নিয়া নেওয়া হয়েছে সুন্নিয়তের পরিচয়ের জন্য এবং ট্রাস্ট হল কল্যাণের প্রতীক।

মাসিক তরজুমান

হুজুর ক্বেবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‌আলা আলায়হির চিন্তাধারা ছিল সুন্নিয়তের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত সুদূর প্রসারী। আর প্রকাশনা হলো কোন আদর্শকে দীর্ঘ ও গ্রহণযোগ্যতা প্রদানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ১৯৭৬ এর ১৬ ডিসেম্বর তারিখে তিনি বাংলা ভাষায় সুন্নিয়াত ভিত্তিক সাহিত্য প্রকাশনার উপর গুরুত্বারোপ করে মাসিক ‘তরজুমান এ আহলে সুন্নাত’ প্রকাশের নির্দেশ দেন এবং জানুয়ারি ১৯৭৭ থেকে আনজুমান থেকে এ প্রকাশনার যাত্রা শুরু হয় এবং পরবর্তীতে নিবন্ধন লাভের পর অদ্যাবধি সুন্নিয়তের শীর্ষস্থানীয় মাসিক প্রকাশনার ক্ষেত্রে এখনো প্রধান এবং প্রাচীনতম স্থানটি দখল করে আছে। বর্তমানে এটা সুন্নিদের নিয়মিত এবং সর্বজনীন প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রধান অবলম্বন হয়ে আছে। যা হুজুর কেবলার উক্তি ‘ইয়ে তরজুমান বাতেল ফেরকাকে লিয়ে মউত হ্যায়’ এর বাস্তবতা বটে।

দাওয়াতে খায়র

দা’ওয়াতে খায়র’ গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসৃত ও পালিতব্য একটি সময়োপযোগী কর্মসূচি। ‘দা’ওয়াত’ বলতে বুঝায়- আহ্বান করা, আমন্ত্রণ জানানো আর ‘খায়র’ মানে হলো- উত্তম, ভালো, কল্যাণ ইত্যাদি। সুতরাং ‘দাওয়াতে খায়র’ বলতে বুঝায় ‘কল্যাণের প্রতি আহ্বান করা’ বা আমন্ত্রণ জানানো।
কুরআনে করীমের সূরা আল-ই ইমরান, আয়াত-১০৪-এ আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَّدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
উচ্চারণ:‘‘ওয়ালতাকুম্ মিন্কুম উম্মাতুইঁ ইয়াদ্‘ঊ-না ইলাল খায়রি ওয়া ইয়া’মুরূ-না বিল্ মা’রূ-ফি ওয়া ইয়ান্হাউনা ’আনিল্ মুন্কার। ওয়া উলা—-ইকা হুমুল মুফলিহু-ন।’’
তরজমা: ‘তোমাদের মধ্যে একটা দল এমন থাকা চাই, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ থেকে নিষেধ করবে, আর এসব লোকই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে।’ [সূরা আল-ই ইমরান: আয়াত-১০৪, কান্যুল ঈমান]
দা’ওয়াতে খায়র’শিরোনামটি মূলত: উক্ত আয়াত থেকেই নেওয়া হয়েছে। এ আয়াত শরীফে দা’ওয়াত এবং খায়র শব্দযুগল যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি এ কাজের প্রকৃতি সম্পর্কেও বর্ণনা রয়েছে। তাই দরবার-এ আলিয়া কাদেরিয়া, সিরিকোটিয়া শরীফের অন্যতম সাজ্জাদানশীন এবং আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র নির্বাহী সভাপতি হযরতুলহাজ্ব আল্লামা পীর সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ (মু.যি.আ.) এ কর্মসূচির নাম দিয়েছেন ‘দা’ওয়াতুল খায়র’ বা দা’ওয়াতে খায়র’ অর্থাৎ ‘কল্যাণের পথে আহ্বান করা’ বা ‘কল্যাণের পথে দাওয়াত দেওয়া।’

আনজুমান রিসার্চ সেন্টার

হুযূর ক্বেবলা পীরে বাঙ্গাল রওনক্বে আহলে সুন্নাত হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ সাহেব মুদ্দাযিল্লাহুল আলী সময়োপযোগী রিসার্চ বা গবেষণা ও প্রকাশনার নিমিত্তে একটি যথোপযুক্ত ‘রিসার্চ সেন্টার’ (গবেষণা কেন্দ্র) স্থাপন ও সেটার যথাযথ পরিচালনার ব্যবস্থাপনার জন্য সদয় নির্দেশ দিয়েছিলেন। আলহামদুল্লিল্লাহ্, হুযূর ক্বেবলার এ বরকতময় নির্দেশ পালনে আনজুমান কর্তৃপক্ষ বিন্দুমাত্র ত্রুটি বা কার্পণ্য করেননি বরং মহান মুর্শিদের অমীয় বাণী ও নির্দেশকে যথাযথভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়েছেন। কোন কালক্ষেপন না করে আলমগীর খানক্বাহ্ শরীফের ২য় তলায় হুযূর ক্বেবলার এরশাদ (নির্দেশনা) অনুসারে ‘রিসার্চ সেন্টার’-এর অফিস ও এর পাশে একটি ‘প্রশিক্ষণ অডিটোরিয়াম’ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
উল্লেখ্য, বিগত ২১/০১/২০১৫ ইংরেজি তারিখে আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন, প্রাণাধিক প্রিয় মুর্শিদে বরহক, বর্তমান হুযূর ক্বেবলা আলম বরদারে আহলে সুন্নাত হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেব ক্বেবলা দামাত বরকাতুহুমুল আলিয়া নিজ বরকতময় হাতে উক্ত অফিস উদ্বোধন করেছেন; আর উক্ত উদ্বোধনকালে হুযূর ক্বেবলার সুযোগ্য সাহেবজাদা সৈয়্যদ মুহাম্মদ ক্বাসেম শাহ্ সাহেব মুদ্দাযিল্লুহুল আলীসহ আনজুমান নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। যা আন্জুমানের যুগান্তকারী ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।